রোহিঙ্গা সংকট : আমাদের কী উপায়

আমাদের দেশের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার ক্যাম্পগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ঠিক কত? এগারো লক্ষ? বারো লক্ষ? সরকারি হিসাব খুঁজলেই আপনি পেয়ে যাবে কোথাও না কোথাও—সেই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।

রোহিঙ্গারা এখানে রয়েছে পাঁচ বছরের মতো, এই পাঁচ বছরে ওদের সন্তান হয়েছে। যে কিশোরী আরাকান থেকে পালিয়ে এসেছিল ২০১৭ সালে ওরা যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে, ওদের অনেকেই বিয়ে করেছে, ওদেরও বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে এবং হবে। বারো লক্ষ মানুষের এই জনগোষ্ঠী আপনি কতদিন ক্যাম্পে আটকে রেখে ভরণ পোষণ দিবেন? এই জনগোষ্ঠী নিজেদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে না?

আমাদের নিজেদের দেশের স্বার্থেই ওদেরকে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো জরুরি—রোহিঙ্গাদের স্বার্থেও ওদের নিজেদের দেশে ফেরত যাওয়া জরুরি। একটা পুরো জনগোষ্ঠী এইরকম নিজেদের স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত অবস্থায় ভিন্ন দেশে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বছরের বছর তো থাকতে পারে না।

ওদের অধিকার আছে নিজের দেশে, নিজের ভূমিতে, নিজের বাড়িঘরে ফেরত যাওয়ার, যেখানে ওরা পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে নিজেদের জন্যে নিজেদের সন্তানদের সুন্দর জীবন ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যে কাজ করবে।

বাংলাদেশের সরকার এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক কারণে সহানুভূতিশীল বটে। কিন্তু আমাদের পক্ষে এই বিপুল জনসংখ্যা খুব বেশিদিন আশ্রয় দেওয়া কঠিন। আমাদের দেশ ছোট এবং আমাদের জনসংখ্যাও বিপুল। আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যও সেই রকম সচ্ছল নয় যে আমরা রোহিঙ্গাদের দিনের পর দিন খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা এইসব ব্যবস্থা করতে পারব।

আমাদের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই পরিষ্কার, সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দিতে নারাজ। কেননা শরণার্থী মর্যাদা দিলে ওদের কিছু অধিকার জন্মায়, বোধগম্য কারণেই সরকার ওদের সেই রকম কোনো অধিকার দিতে রাজি নয়। সরকার চায় ওরা যেন দ্রুত নিজেদের দেশে ফিরে যায়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৮০০ আখড়ায় চলে মাদক চোরাচালান আর পাঁচ বছরে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১২৩ জন্য মানুষ খুন হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে চাপটা যে শুধু আমাদের অর্থনীতির উপর পড়ছে তা-ই নয়, নানারকম সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যাও হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি এইসব সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৮০০ আখড়ায় চলে মাদক চোরাচালান আর পাঁচ বছরে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১২৩ জন্য মানুষ খুন হয়েছে। এইসব ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে নিয়োগ করতে হয়েছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, মিলিটারি ও অন্যান্য বাহিনী। (প্রথম আলো, ২৫ আগস্ট ২০২২)

ওদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উপায় কি? মিয়ানমার সরকার যদি না চায় তাহলে তো এতগুলো মানুষকে জোর করে সীমান্তের ওপারে ঠেলে পাঠানো যাবে না। সেটা যদি সম্ভব হয়ও, মিয়ানমারের বৈরী পরিবেশে ওদের জোর করে ফেরত পাঠানো তো মানবিক কাজ হবে না—ওরা নিজেদের দেশে ফেরত গেলে আবার আগের মতো অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হবে না সেই নিশ্চয়তা তো নেই।

ওদের ফেরত পাঠানোর আগে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস পেতে হবে যে ওরা নিজেদের দেশে ন্যূনতম নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারবে আর ওদের প্রতি সরকার কোনো বৈরী আচরণ করবে না।

মিয়ানমার সরকারের পক্ষে থেকে এইরকম আশ্বাসের কোনো সম্ভাবনা তো দেখাই যাচ্ছে না। এই রোহিঙ্গাদের তো ওরা স্পষ্ট করে নিজেদের নাগরিক বলেই এখনো পর্যন্ত স্বীকার করছে না। তাহলে তো উপায় থাকে দুইটা।

এক, রোহিঙ্গারা যুদ্ধ করে নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে মিয়ানমার সরকারের সাথে সমঝোতায় পৌঁছতে পারে; দুই, সব দেশ মিলে যদি মিয়ানমারের উপর কার্যকর চাপ তৈরি করতে পারে তাহলে হয়তো মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্যে কিছু নাগরিক অধিকার দিয়ে ওদের ফেরানোর ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু এই দুইটার কোনো একটা সমাধান যে খুব শিগগিরই হবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা কি আপনারা দেখতে পান? আমি দেখি না।

এই অবস্থা কেন সৃষ্টি হয়েছে? কেন পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো রোহিঙ্গাদের পক্ষ হয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না? চীন তো মিয়ানমার সরকারের বড় পৃষ্ঠপোষক, চীনের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমাদের প্রতিবেশী ভারত, বড় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এরা কেন শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না?

এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তিগুলো—মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এরাই বা কেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়ে বসে আছে? এই ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা যে রয়েছে সেকথা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তারচেয়েও বড় কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী চরিত্র।

আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা যে রয়েছে সেকথা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তারচেয়েও বড় কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী চরিত্র….
বিশ্বের বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে পৃথিবীর কোনো দেশই এমন একটা জনগোষ্ঠীর পাশে খুব শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়াবে না যাদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলো কোনো না কোনোভাবে মুসলিম টেররিস্ট গ্রুপ বলে মনে হয়।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর যখন মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর দমন পীড়ন শুরু হয় তার ঠিক আগে আরাকনের মংডু ও বুছিডং এলাকায় রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (Arakan Rohingya Salvation Army) বা আরসার গেরিলারা অনেকগুলো পুলিশ ও মিলিটারি পোস্টে হামলা করে কিছু ক্ষয়ক্ষতি করেছিল।

গণমাধ্যমে দেখেছি, সেই সময় আরসার হামলা থেকে রোহিঙ্গা হিন্দুরাও রক্ষা পায়নি—অভিযোগ আছে যে, আরসার রোহিঙ্গা মুসলিম গেরিলারা রোহিঙ্গা হিন্দুদের গ্রামে হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যাসহ নানারকম অত্যাচার করেছে।

এখানে যেসব রোহিঙ্গা আছে, ওদের মধ্যে কিছুসংখ্যক হিন্দু রোহিঙ্গাও রয়েছে। এই হিন্দু রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর অত্যাচারে পালিয়ে এসেছে ঠিকই, এখানে এসে ওরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে এক ক্যাম্পে থাকাটা নিরাপদ মনে করেনি। ফলে ওদের জন্যে আলাদা ক্যাম্প করতে হয়েছে।

রোহিঙ্গ সংকট দিনকে দিন যেভাবে প্রকট হচ্ছে সেক্ষেত্রে আগেই আমাদের অনেক বেশি কঠোর হওয়া উচিত ছিল। সেক্ষেত্রেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতা কতদিন টানতে হবে তা কেউই বলতে পারছে না।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট